Music

Header Ads

আমি কবর বলছি...

 আমি কবর বলছি...

আখিরাতের প্রথম মঞ্জিল তো আমিই।

.
অধিকাংশ মানুষই জীবনভর আমার কথা একদমই স্মরণ করেনা। আমার সাথে সাক্ষাতের ব্যাপারে এরা প্রচন্ড রকমের গাফেল।
কিন্তু আমি যে এক ধ্রুব সত্য!
কিংবা বলতে পারো এক নিষ্ঠুর বাস্তবতা।
আজ নয়ত কাল আমার সাথে মোলাকাত করতেই হবে, এড়ানোর সুযোগ নেই।
.
শুনেছি দুনিয়ায় একটা ঘর সাজাতে মানুষ বিরাট আয়োজন করে। সারাজীবনের অর্থ, শ্রম, শক্তি, মেধা- সবকিছু খরচ করে ঘর বানায়, অথচ কয়দিনই বা সেই ঘরে থাকতে পারে?
শেষমেষ আমার ভেতরই তো তাদের প্রত্যাবর্তন।
শত শত মানুষের আর্তনাদে ভারি হয়ে ওঠে আমার বুক।
.
মানুষ যে কেন কবরের জীবনটা নিয়ে সতর্ক হয়না!
পুনরূত্থান পর্যন্ত কত লম্বা একটা সময় এই ঘরটায় থাকতে হবে, অথচ কি ভয়ানক নোংরা, বিদঘুটে আর বিপদসংকুল করে রাখে! সত্যিই, কতই না হতভাগা এরা!
.
চাইলেই আমাকে নিজেদের জন্য মনোরম করে সাজিয়ে নেয়া যায়। কিন্তু দুনিয়াতে বুঁদ হয়ে আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে হবে- এই ইয়াকীনটাই হারিয়ে ফেলে।
.
কত অর্থ আর আহলকে আমার দ্বারপ্রান্তে এসে ফিরে যেতে দেখি! মানুষটা হয়ত এই দুয়ের পিছনেই জীবনটা বিলিয়ে দিয়েছে, অথচ এরাই তাকে রেখে চলে যায়!
আর অধিকাংশ বান্দা ঈমান আমল না নিয়েই ফিরে আসে।
অথচ, সেটাই সবচেয়ে বেশি দরকার ছিলো আমার অন্ধকার বুকে সুন্দর ও সম্মানজনক নিবাসের জন্য!
.
হ্যাঁ, ঈমান-আমলের মাপকাঠির ভিত্তিতেই আল্লাহ আমাকে আদেশ করেন যে ঐ লাশের সাথে আমাকে কেমন আচরণ করতে হবে। এর আগে মুনকার-নাকীর নামে দুজন ভয়ানক ফেরেশতা এসে প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ করেন।
.
আমার অনুমান খুব ভুল না হলে এই প্রশ্নোত্তর পর্ব দুনিয়ার বুকে ফাঁস হয়ে গেছে অনেক আগেই।
রব কে, দ্বীন কী, আর নবী কে- এই তিনটা বিষয়ে প্রশ্ন হয়।
খুবই মৌলিক বিষয়, তবুও কত মানুষ উত্তর দিতে পারেনা! নির্বাক চেয়ে থাকে। বড়ই আশ্চর্য লাগে তখন!
তোকে আমি কি দিয়ে আপ্যায়ন করবো রে হতভাগা! কি করে এসেছিস সারাজীবন!
.
যাই হোক, ‘আবেগ’ জিনিসটা আমাকে মানায় না।
কিন্তু ৬০/৭০ বছর হায়াত পেয়েও নিজের রবকে, দ্বীনকে আর নবীকে চেনেনা- প্রতিদিনই এমন হাজার হাজার হতভাগার সাথে নতুন করে সাক্ষাৎ হয়।
এমন কতজনকে মানুষ আমার বুকে রেখে যায়, যার ঈমান-আমলের খাতা প্রায় শূন্য। কিন্তু কবরে নামানোর সময় অনেক আয়োজন করে ‘বিসমিল্লাহি ওয়া ‘আলা মিল্লাতি রাসূলিল্লাহ’; পড়া হয়। হিসাব নিকাশের পর বুঝতে পারি, মানুষটা আসলে সারাজীবন মিল্লাতে রাসূলকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েই এসেছে। নইলে ঈমান-আমলের এমন বেহাল দশা হবে কেন?
.
আমার কারো জন্যই কিছু করার থাকেনা। কারণ আমি কেবলই আমার রবের হুকুমের দাস।
.
তাঁরই আদেশে নাফরমান বান্দাদের উপর নেমে আসে ৫ ক্যাটাগরির ভয়াবহ আযাব, যার উদ্বোধনটা আমাকে দিয়েই করানো হয়। আল্লাহর হুকুম পাওয়া মাত্র মাইয়্যেতকে এমনভাবে সংকীর্ণ করতে শুরু করি যে, তাদের এক পাঁজরের হাড় অপর পাঁজরে গিয়ে ঠেকে!
এ এমন এক চাপ! যার যন্ত্রণা লোকটাকে দুনিয়ার সমস্ত সুন্দরতম আলিঙ্গনের মুহূর্তগুলো ভুলিয়ে দিতে বাধ্য।
.
আল্লাহর জমিনে থেকেছে, আল্লাহর খেয়েছে, আল্লাহর নিয়ামত ভোগ করেছে; অথচ তাঁরই অবাধ্যতা করে গেছে সারাজীবন! তাওবা করারও প্রয়োজন মনে করেনি। আহারে! কোথায় এখন তোর অহংকার?
.
বাকি শাস্তিগুলোরও নীরব প্রত্যক্ষদর্শী আমি। একে একে তাকে জাহান্নামের পোশাক ও বিছানা দেয়া হয়; এরপর জাহান্নামের দিক থেকে একটা দরজা খুলে দেওয়া হয়। সবশেষে দুই ফেরেশতার পক্ষ থেকে এমন এক হাতুড়ি দিয়ে অনবরত আঘাত করা হতে থাকে, যেই হাতুড়ির এক আঘাত বিশাল পাথরের পাহাড় চূর্ণবিচূর্ণ করে ধুলায় পরিণত করতে পারে!
.
এভাবে, মুহূর্তেই মাইয়্যেতের জীবনটা হয়ে ওঠে এক পশলা জাহান্নাম! পুনরুত্থান পর্যন্ত এভাবেই পাপাচারীরা আমার বুকে শুয়ে পঞ্চমূখী শাস্তি ভোগ করতেই থাকে।
.
আমার ধারণা, আজাবপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের চিৎকার মানুষ একদমই শুনতে পায়না। নইলে এত মানুষ অপ্রস্তুত হয়ে কবরে আসতো না কোনোভাবেই।
.
যাহোক, ব্যর্থদের গল্প আজ থাক। সফলদের গল্প বলি এবার।
...
কিছু বান্দা ঈমান আর আমল নিয়েই আসে। এদের প্রশান্ত ও নূরানী চেহারা দেখেই মনে হয় এরা ঠিক উত্তর দিতে পারবে। সুন্দরভাবে উত্তর দেয়ার পরে ওই দুই ফেরেশতা সফলতার নেপথ্য কারণ জানতে চায়। জবাব শুনেই নিশ্চিন্তে বলে দেয়া যায়, আখিরাতের পড়াশুনাটা বেশ ভালোভাবেই করে এসেছে।
.
আল্লাহ সুবহানু ওয়া তা’আলা এমন ব্যক্তিদের নগদ পাঁচ ধরণের পুরস্কার দিবেন।
যথারীতি এবারও প্রথমটার সাথে আমি সরাসরি জড়িত। এরকম সম্মানী বান্দাদের থাকার সুব্যবস্থার জন্য আমাকে চাপ না দিয়ে অনেকদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে যাওয়ার আদেশ দেয়া হয় এবং আমি অক্ষরে অক্ষরে তা পালন করি। এরপর আমার অন্ধকার বুককে বান্দার জন্য আলোকিত করে দেয়া হয়। আলোকিত বান্দা, আলোকিত তাঁর কবর- সত্যিই আল্লাহর বিচারই সর্বশ্রেষ্ঠ!
.
এরপর বান্দাকে জান্নাতের লেবাসে সাজিয়ে তাঁর জন্য জান্নাতের বিছানা বিছিয়ে দেওয়া হয় আর জান্নাতের দিকে একটা দরজা খুলে দেওয়া হয়। মোটমাট জান্নাত না হলেও ‘জান্নাতের আগে এক পশলা জান্নাতের অনুভূতি’ বললে খুব একটা ভুল হয়না!
.
এভাবে পুনরূত্থান দিবস পর্যন্ত আমার বুকেই পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকবে আল্লাহর সম্মানিত নেককার বান্দাগণ।
আমিও তাঁদেরকে পেলে গর্বিত হই।
.
তোমরা অনেকেই এখনো জীবিত আছ, এখনো মাটির ওপরে ঘুরাঘুরি করতে পারছ-
মনে রেখো, আজ নয়ত কাল আমার কাছে আসতেই হবে। এই দুই শ্রেণীর বান্দার ঈমান-আমল বিশ্লেষণ করে মোটাদাগে যা বুঝেছি, বারযাখী এই জীবনটাকে এক টুকরা জান্নাতের বাগানে পরিণত করতে কিছু করণীয় ও বর্জনীয় রয়েছে। হয়ত তোমরা অনেকেই জানো, তবুও আরেকবার সতর্ক করে দিচ্ছি, যদি কারো উপকারে আসে!
.
করণীয়ঃ
১। সবার আগে বিশুদ্ধ ঈমান নিয়ে আসতে হবে। এটার বিকল্প একদমই নেই। কত পাহাড়সম আমলওয়ালা মানুষ আসে, বিশুদ্ধ ঈমান আনতে না পারার কারণে আমার আযাব থেকে রক্ষা পায়না।
.
২। প্রতিরাতে সুরা মূলক পাঠ করতে হবে। এটাকে খুব কাজে দিতে দেখেছি।
.
৩। নিয়মিত কবরের আযাব থেকে পরিত্রাণের দুয়া করাও অনেক কার্যকর।
.
৪। সহিহ শুদ্ধ যিকিরগুলো দিয়ে মুখটাকে সবসময় ব্যস্ত রাখা মানুষগুলোকেও সফল হতে দেখেছি।
.
৫। দান-সাদাকার কথা না বললেই নয়; বিশেষ করে সাদকায়ে জারিয়া যে কত বড় পাথেয় হতে পারে, এটা বুঝানো সত্যিই অসম্ভব। সবাইকেই অন্তত একটা হলেও সাদাকায়ে জারিয়া চালু রেখে আসার চেষ্টা করতে নসীহা করছি।
.
৬। এছাড়াও মাইয়্যেতের প্রতি আল্লাহর আচরণ থেকে ফরজ নামাযের পর নিয়মিত আয়াতুল কুরসী, আউয়াল ওয়াক্তে বিশুদ্ধভাবে সালাত আদায়, অযুর পরে কালেমায়ে শাহাদাত, আযানের জবাব- ইত্যাদি জান্নাতের নিকটবর্তী আমলগুলোও পরোক্ষভাবে বেশ সহায়ক বলে মনে হয়েছে।
.
.
বর্জনীয়:
১। কোনোভাবেই শিরকযুক্ত ও ত্রুটিপূর্ণ ঈমান নিয়ে আসা যাবেনা; এটা কবরের আযাবের প্রধান কারণ। যে ঈমানটা ঠিকমত বিশুদ্ধ করে আনতে পারবেনা, ওয়াল্লাহি! তার সব শেষ হয়ে যাবে। হুঁশিয়ার করে দিলাম! ঈমানটা ঠিক না করে আমার কাছে এসো না! চিরস্থায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাবে!
.
২। কবীরা গুনাহ করার পর তাওবাবিহীন অবস্থায় মারা যাওয়া হতভাগাদের কবরে প্রচুর শাস্তি হয়। মানুষ গুনাহ করবে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু সে যখন গুনাহর পরে তওবার ব্যাপারে উদাসীন থাকে, এটা তার জন্য ভয়াবহ বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল। যতই গুনাহ করে থাকো, মাফ চাও। কিন্তু অহংকার করে যদি মাফই না চাও, গুনাহকে গুনাহই মনে না করো; তবে আমার চাপে পিষ্ট হবার জন্য তৈরি হয়ে এসো, কেমন?
.
৩। গীবত ও চোগলখুরি- এই দুইটা স্বভাবের কারণে অনেক আমলওয়ালা ব্যক্তিও ধরা খেয়ে যায়। এই দুইটা ছাড়া সম্ভবত আসলেই কঠিন। কিন্তু কবরের আযাব ভোগ করার চেয়ে সোজা, এটুকু গ্যারান্টি দিতেই পারি।
.
৪। পেশাবের ছিটা থেকে বাঁচার ব্যাপারে অনেকেই গাফেল। এই অশুচি কাজটা থেকেও বেঁচে থাকতে হবে।
.
৫। অন্যের হক নষ্ট করার কারণে অনেকের কড়া শাস্তি হতে দেখেছি।
.
৬। আরেকটা বিষয় সেভাবে জোর দিয়ে বলা হয়নি, তো বলেই ফেলি। বান্দাকে যখন কবরে প্রশ্নোত্তরের পর্বের জন্য জাগিয়ে তোলা হয়, তখন আমার ভেতরের পরিবেশটা এমনভাবে সাজিয়ে তোলা হয়, যেন আসরের ওয়াক্ত প্রায় শেষ হয়ে আসছে।
.
বস্তুতঃ এটা কবরে বান্দার জন্য একটা মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা। যারা সত্যিকারের সালাত আদায়কারী বান্দা, উঠার পর তাঁদের কাছে মনে হয়, একটু যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলো আর এর ফাঁকে আসরের ওয়াক্ত প্রায় শেষ! সবকিছু ভুলে এরা আসরের সালাতটা পড়ার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে।
.
কিন্তু সাথে সাথে ফেরেশতারা এই মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষায় তাঁদের সফলতার সুসংবাদ জানিয়ে দেন যে, বারযাখী জীবনে আর সালাতের প্রয়োজন নেই, এই তৈরি করা সিচুয়েশনটা আসলে একটা পরীক্ষা ছিলো মাত্র।
.
কিন্তু সালাতের সাথে যাদের নিয়মিত সম্পর্কই নেই, তারা এই পরীক্ষায় পাশ করা দূরের কথা, এটা যে পরীক্ষা- তাও ধরতে পারবেনা। সালাত এভাবেই ঈমান আর কুফরের পার্থক্য করে দেয়।
.
সুতরাং, যারা কবরের প্রশ্নোত্তর পর্ব সহজে পাশ করতে চাও, কোনোভাবেই সালাতের ব্যাপারে গাফেলতি করো না।
.
এই-ই মোটামুটি বলার ছিলো তোমাদের প্রতি। প্রত্যেকের সাথেই আমার দেখা হবে। আমার পরে আরো স্টেশন আছে। তবে, আমার ধাপটা যারা সুন্দরভাবে উতরে যাবে, তাঁদের জন্য বাকি ধাপগুলোও সহজ হয়ে যাবে বলে আশা করি।
.
আমি হুকুমের গোলাম। তোমাদের ভয়ানক চাপ দিয়ে গুঁড়াগুঁড়া করে ফেলার আদেশ পেলে আমার কিছুই করার থাকেনা।
শুধু এটুকুই বলবো, পর্যাপ্ত প্রস্তুতি না নিয়ে কেউ এসো না, কেমন? বিশ্বাস করো, কবরের চাপ এমন ভয়াবহ এক যন্ত্রণা- সহ্য করতে পারবেনা।
তাই, আজ থেকেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করো, যেন পুনরূত্থান অব্দি আমার বুকে ফুলের বাগান বানিয়ে আরামে ঘুমাতে পারো।
.
ঈমানদারদের জন্য শুভকামনা। তোমাদেরকে সুন্দরভাবে বরণ করার অপেক্ষায় ...
'আমি কবর বলছি'

Post a Comment

0 Comments